পদ্মাপারের চুপকথা

 

 

নদীর ধারে চুপ করে বসেছিল পিপুল । রাতের অন্ধকার আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছিলো । পূবের আকাশে সোনালী আলোর রেখা দেখা দিয়ে যেন বলতে চাইছিলো “রাতের শেষ, এবার একটা নতুন দিনের শুরু হতে চলেছে । তৈরী হও পিপুল ।”

পূব দিগন্তের রক্তিম আভায় পদ্মানদীর ঢেউ গুলো যেন আরও মায়াবী হয়ে উঠেছিল । নদীর ধারে কাশবনের তিরতির কম্পন , ভোরের পাখিদের কলতান , আর পদ্মাপারের শীতল হাওয়ার মৃদু গুঞ্জন – সব যেন একত্রে আবাহন করছে নতুন সূর্যকে ।

ভোরের আকাশে পটচিত্র আঁকছে সূর্যের কমলা আভা, আর তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে পদ্মার স্থির জলে । পদ্মা যেন আজ শুধু পিপুলের জন্যই এতো যত্ন করে এই জলছবি আঁকছে । সমস্ত পদ্মাপারে যেন আজ এক মহোৎসবের আয়োজন চলছে, তারা সবাই আজ প্রস্তুতি নিয়েছে এক অপূর্ব সকাল পিপুল কে উপহার দেবে বলে । পদ্মাপারে আজ সাজ সাজ রব পরে গেছে । ওই যে, সে আসছে । পিপুল দেখলো, ওই যে , শোনা যায় , ভোরের আগমনী ।

পিপুল একবার নদীর ওধারে চেয়ে দেখলো, শুধু সবুজ ধানের ক্ষেত , আর তার মাঝে, একটা কাঁটাতারের বেড়া । পিপুল যেন শুনতে পেল , কেউ তাকে ডাকছে, বহুদূর থেকে একটা ডাক সে শুনতে পাচ্ছে । কেন জানিনা ওর মনে হচ্ছে , আজই ওর জীবনের শেষ পদ্মাপারের ভোর । তাই সে চাইছে সমস্ত নির্যাসটুকু নিংড়ে ওর মনের মধ্যে আজকের ভোরের আলোকে বরণ করে নিতে ।

“কি রে পিপুল, শুনতে পাচ্ছিস না? সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি তোকে, তুই কোনো সাড়াই দিচ্ছিস না । কি রে , কি হলো ?”

পিপুল যেন কোথায় হারিয়ে গেছিলো, এখন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলো । ঘুরে দেখলো কখন যেন মা এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। সত্যিই সে কিছুই জানতে পারেনি, মা এর ডাকও শুনতে পায়নি ।

“তুমি কখন এলে ? “, পিপুল জিজ্ঞেস করলো মা কে ।

-“নন্দা পিসি এসেছে , বলছে তোকে নিয়ে যাবে ।”

পিপুল আকাশ থেকে পড়লো । নিয়ে যাবে? কোথায়? ও যে এই পদ্মা কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না । কোথায় যাওয়ার কথা বলছে মা ?

-“আরে এখানে বসে বসে কি ভাবছিস বলতো ? চল, চল । অনেক কাজ এখন । তোর সব পোশাক আশাক গুছাতে হবে তো , চল এখন ।”

-“মা , কোথায় যাবো আমরা ? নন্দা পিসি কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের ?”

মা হঠাৎ চুপ করে গেলো । কি যেন ভেবে মা বললো , “হ্যাঁ , এক জায়গায় যাবো । তোকে সব কথা পরে বলবো, এখন আয় তো, ঘরে আয় দেখি । “

পিপুল উঠে দাঁড়ালো । মায়ের সাথে আসতে গিয়েও কি যেন ভেবে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো । মা ও ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ।

“ও বাবা, আবার কি হলো তোর? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?

পদ্মার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে পিপুল বললো, “তুমি যাও , আমি আসছি ।”

-“আবার কি হলো তোর? অনেক কাজ এক্ষন আমাদের, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে, চল ।”

পিপুল একটুও নড়লো না । সে ওভাবেই তাকিয়ে বললো, “বেশি দেরি করবো না, কথা দিচ্ছি । তুমি যাও , আমি এক্ষুনি আসছি ।”

মা আর কিছু বললো না, শুধু যেতে যেতে বলে গেলো ” আচ্ছা , ঠিক আছে, বেশি দেরি করিস না বাবা । তাড়াতাড়ি আসিস । আমি চললাম, বুঝলি ।”

পিপুল শুধু মাথা নেড়ে বললো , “হুঁ “।

মা চলে যেতেই পিপুল দৌড়ে গেলো নদীর ধরে, কাশবনের মধ্যে দিয়ে এক ছুটে পৌঁছে গেলো তার প্রিয় নারকেল গাছের নিচে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দেখলো তার প্রিয় পদ্মা কে, আর ঝুপ করে ঝাঁপ দিলো পদ্মার জলে । পাশ দিয়ে একটা ছোট্ট ডিঙা করে মাঝি গান গাইতে গাইতে চলে গেলো ,

“ও সোনা বন্ধু রে , কইয়া যাও , কইয়া যাও , কবে আসিবে ফিরে , মোর এই ঘরে ।”

*******

সত্তর বছর পার হয়ে গেল , পিপুলের আর ঘরে ফেরা হয়নি । জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার মনে পড়ত সেই রাতের কথা । ও যখন তার ছোট্ট পুঁটলিটা নিয়ে নন্দা পিসির সাথে ডিঙায় উঠল, তখনও পিপুল জানতো না , সে আজ তার মা কে ছেড়ে একা যাচ্ছে । এই প্রথম সে তার পদ্মা পারের ছোট্ট পৃথিবী ছেড়ে এক অন্য পৃথিবীর খোঁজে পাড়ি দিচ্ছে । এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মায়ের কল ছেড়ে আরেক মায়ের কোলে ।

ডিঙায় ওঠার আগে পর্যন্ত পিপুল জানতো না, সে একাই যাচ্ছে নান্দা পিসির সাথে । যখন সবাই একে একে ডিঙ্গায় উঠে পড়ল , ডিঙা ভরে গেল , সে দেখলো মা তখনও আসেনি । মুখ ফিরিয়ে মা কে খুঁজতে গিয়ে দেখলো, মা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে ।

পিপুলের কাছে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেলো । কিন্তু ততক্ষনে যে অনেক দেরী হয়ে গেছে , পিপুল ফিরতে চাইলো, কিন্তু ফেরার পথ যে বন্ধ ! পিপুল মা কে শেষবারের মত কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করলো , “মা, তুমি যাবেনা ?” নোনা জলে তার চোখ ভিজিয়ে দিলো ।

মা ধরা গলায় বললো, “ধুর বোকা, আমি তো তোর সাথেই থাকবো রে । শুধু এক মা এর কোল ছেড়ে  তুই আরেক মা এর কোলে চললি । পিপুল, সেই মা কে বুকে জড়িয়ে নিস্ বাবা , সেই মায়ের গায়ের গন্ধে তুই আমাকেই খুঁজে পাবি । রাতে ঘুম না আসলে, সে তোকে আমারই মতো ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে ঘুম পাড়াবে । সেও যে তোর আরেক মা, সে ভিন্ন কেউ নয় রে, সে যে আমারই আরেক রূপ ।

পিপুল মায়ের কথা রেখেছিল । পদ্মা পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে সে ফেলে এসেছিলো তার জন্মভিটা । এপারে আসার এক মাসের মাথায় সে জানতে পারে , তার মা সেই রাতের কথা ভুলতে পারেনি । স্বামী মারা যাওয়ার পর একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে সে থাকতে পারেনি, বুকের ভিতর এক কষ্ট চেপে রেখে সে সে বিদায় নিয়েছে চিরতরে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে । পিপুল একথা জানার পর মায়ের উপর এক অজানা অভিমান তাকে গ্রাস করে । সে নিজের কাছেই নিজে কথা দেয় , আর কখনো সে পদ্মাপারে ফিরবে না ।

কিন্তু জীবনের শেষ দিন গুলোয় , তার ধূসর হয়ে আসা গোধূলির স্মৃতির পাতায় , প্রায়শই উঁকি দিতো সেই রাতের কথা । সে ফায়ার যেত তার পদ্মাপাড়ের সেই ভোরের কাছে, মনে হতো, নিজের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে , সমস্ত ভাঙ্গন ছিন্ন করে , তার ছিন্নমূলের কাছে ফায়ার যেতে ।

কিন্তু, পিপুলের আর ফেরা হলোনা ।

পদ্মাপারের চুপকথারা এখনো ফিসফিয়ে গান গেয়ে যায়, “সোনা বন্ধু রে, কবে আসিবে ফিরে , কইয়া যাও , কইয়া যাও..”

একলা ভিটেয় অপেক্ষা করে আছে তোমার মা, তোমার মায়ের পদচিহ্ন যে আজও তোমার অপেক্ষায় দিন গোনে । কইয়া যাও , কবে আসিবে ফিরে । পদ্মাপারের ভোর এখনো তোমার অপেক্ষায় ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

%d bloggers like this: