
আজ লিখতে বসার আগে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে ছিলাম | অনেক কিছুই ভাবছিলাম | মনের ভিতর যেন একটা ঝড় উঠেছিল, কিন্তু সেই ঝড়ের আভাস পেলেও নাগাল পাচ্ছিলাম না | এই অবস্থায় তো শুধু ভাবাই যায়, লেখা যায়না | অগত্যা, আমিও সেই পন্থাই নিলাম | বসে বসে একমনে অনেক কিছু ভাবতে লাগলাম | ভাবতে ভাবতে, এক সময় অনেক গভীরে ডুব দিলাম | সাঁতার হয়তো কাটছিলাম না, কারণ আমি আরো গভীর থেকে গভীরে ডুবে যেতে চাইছিলাম | একটা সময়, আমার অন্তরে কে যেন বলে উঠলো, ‘ওরে, একটিবার চোখ খুলে দেখ |’ শুনতে পেলাম যেন কিছু শব্দ; নাহ , শব্দের শব্দ না, এই শব্দ, নৈঃশব্দের ধ্বনি | ওই যে, ওই কথাটা বললো বটে, কিন্তু যেন অনেক কথা না বলাই রেখে গেলো | যেমন, বলতে বলতেও যেন বললো না, ‘একটিবার তাকিয়ে দেখ, পেলে পেতেও পারিস অমূল্য রতন’ |
কিছুটা অনুভবে, কিছুটা অভিজ্ঞতায়, এক অজানা বিশ্বাস থেকে, অবশেষে চোখ খুললাম | খুলে কি দেখতে পেলাম?
আমার ঘরে পড়াশোনার টেবিলের উপরে রাখা দেবী সরস্বতীর মূর্তি |
অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ওই মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম | মনের ভিতরে যে ঝড়টা উঠেছিল, তা এক সময় থামতে শুরু করলো | ধীর গতিতে আমার মনকে চালিত করতে থাকলাম | চিন্তনে, মননে তখন দেবীকেই ভাবতে লাগলাম নিরক্ষন | ভাবতে ভাবতে আবার চলে গেলাম একটা ভাবের জগতে |
এই যে আমার ভাবের ঘরে যাওয়া আসা, এ তো আজকের নয় | সেই কোন ছোটবেলা থেকেই তো আমার এমনটা হয় | যখন আমার বয়সী অন্য ছেলেমেয়েরা বা আমারই ভাই বোনেরা খেলায় মত্ত থাকতো, আমি বসে থাকতাম এক কোণে চুপটি করে | বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকতাম | আর ভাবতে ভাবতেই, একটা সময় পৌঁছে যেতাম আমার ভাবের জগতে, যেখানে অনন্ত জিজ্ঞাসা আর অপার শান্তি |
যদি এই অনন্ত জিজ্ঞাসার নাম হয় আত্ম সন্ধান, তাহলে অপার শান্তির নাম হলো ধ্যান |
যখন আমি ধ্যানের মানে বুঝতাম না, ধ্যান কি হয় জানতাম না, তখনও আমি ধ্যান করেছি | মনে মনে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে একটা সময় ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়ে ভাবের ঘরে পৌঁছে গেছি আর স্থিরমতি লাভ করেছি | এই ছিল আমার ধ্যান |
তারপর শিখলাম একটা বিন্দুতে মনস্থির করে সমস্ত মনোযোগ ওতে নিয়ে গিয়ে ফেলা | সেটাই হচ্ছে ধ্যান, এমনটা একজন আমায় বললো | শিখলাম, করলাম, এবং একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লাম | কাকভোরে উঠে পড়তে বসার আগে এইভাবে কিছুক্ষন ধ্যান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; কিন্তু প্রায়ই এভাবে ধ্যান করতে করতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম | তাই একদিন ঠিক করলাম, নাহ, আর এভাবে ধ্যান করা যাবে না | অগত্যা, একদিন শেষমেশ ওই ধ্যানের অভ্যাসকেই বর্জন করলাম |
নাহ , একেবারে ছেড়ে দি নি | ধ্যান আমি করে গেছি বরাবর, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে | কখনো স্থিরমতি হয়ে, কখনো বিন্দুতে মনোনিবেশ করে, আবার কখনো কোথাও অপেক্ষারত অবস্থায় দাঁড়িয়ে | যেখানে যেমন, সেখানে তেমন | যখন যেমন, তখন তেমন | ভাবের ঘরে যাওয়া আসা থাকলেই তো হলো!
এমনটাই ভাবতাম | অনেক বছর এমনটা ভেবেই ধ্যান করে গেছি | কখনো নামজপ করতে করতে ধ্যান করেছি, কখনো বা নির্বাক হয়ে থেকেছি | কখনো লিখতে লিখতে, কখনো গান গাইতে গাইতে | কখনো বই পড়তে পড়তে, কখনো গান শুনতে শুনতে | ধ্যানস্থ হয়েছি, স্থিরমতি রয়েছি বেশ কিছুক্ষন, অতল সাগরে একবার ডুব দিয়েই আবার ফিরে এসেছি জাগতিক সংসারে |
আমি তো কোনো সাধু, সন্ন্যাসী, বা সাধিকা নই , তাই আমার কাউকে ধ্যান সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণ সাজে না, আর তা আমি একেবারেই করতে চাইনা | কিন্তু আমি আমার আত্মোপলব্ধি থেকে ধ্যানকে যতটা জেনেছি, আজ তাই লিখতে ইচ্ছা হলো |
ধ্যান মানে তো একটু শান্তির খোঁজ | সোডা ব্যস্ত জীবনে ইঁদুর দৌড়ের থেকে কিছুটা সময় ধার করা একটু শান্ত হয়ে বসার জন্য, বা ক্ষনিকের শান্তির খোঁজে কোথাও একটু গভীরে খোঁজা – কখনো অজানাকে জানার চেষ্টা, কখনও বা নিজের স্বরূপ বোঝার প্রয়াস, আবার কখনো কিছুই না করে শূন্যের কাছে ধরা দেয়ার এক নিরলস অভিপ্রায় |
ধ্যান মানে যেমন হৃদয়পঙ্কজকে প্রস্ফুটিত করার নিরন্তর সাধনা, ধ্যান মানে পরম শান্তিতে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া, আবার ধ্যান মানে এক দরজা বন্ধ করে আরেক দরজা খোলা, যেখানে এক অনন্ত যাত্রা আমাদের জন্যে অপেক্ষারত – যে দ্বাররক্ষী সদাজাগ্রত মনের ‘আত্মজ্ঞানের’ দ্বারে, ধ্যান হলো সেই দ্বাররক্ষীকে দেওয়া ‘অনুমতি’ |
ধ্যান হলো নিরন্তর সেই ধ্বনি, যে ধ্বনির অবস্থান শব্দের প্রাসাদে নয়, নৈঃশব্দের কুটিরে |
একটিবার সেই দ্বাররক্ষী যদি দ্বারটি খুলে দে, বা একটু ফাঁকা করে, এক চিলতে রোদ্দুরের মতোই ঢুকে পড়া যায় অন্তরের সেই ‘আমি’র সংসারে, যেখানে সত্যের দেবী সদা বিরাজিতা, সদা উপাসিতা, সদা জাগ্রতা |
Leave a comment