জীবন রূপকথা নয় |
জানি তো, জীবন তো জীবনই , সে তো রূপকথা হতে পারে না কখনোই | জীবন যদি রূপকথা হয়ে যেত তাহলে তো সব ল্যাটা চুকেই যেত |
কিন্তু জীবনের একটা সময় সত্যি রূপকথা মনে হয় | সেই যে, যখন আমাদের চালচুলোর কোনো ঠিক থাকে না, ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা থাকে না, জীবনে থাকে শুধুই আনন্দ, হাসি, আর একটু আধটু দুঃখ কান্না, যা কিনা শুধুই বন্ধুত্বের আবর্তে আবর্তিত হয় | অমুক বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়েছে, তাই মনে দুঃখ পেয়েছি, অমুক বন্ধু আমায় মিথ্যা বলে ফাঁসিয়ে দিয়েছে, কথা ছিল সবাই মিলে একসাথে টিউশন যাবো না, কিন্তু ও যে চলে গেলো, স্যার তো ক্লাস টেস্ট নিয়েও নিলেন, তাহলে এবার যে গার্জেন কল হবে? চল, সবাই মিলে ওকেই ধরে বয়কট করে দি আমাদের গ্যাং থেকে |
কিন্তু ও জাস্ট কিছুদিনের জন্যই, সেই বন্ধুটি, সেই বিশ্বাসঘাতক বন্ধুটি টিফিন ব্রেকে একা একা বসে থাকতো লাস্ট বেঞ্চে, কোনোদিন দেখতাম ডেস্কে মাথা গুঁজে বসে আছে, টিফিনও খায়নি | আহা রে, দেখে একটু কষ্ট হতো বৈকি, কিন্তু ওই যে, ও কথা দিয়ে কথা রাখেনি | কথা মিনস কথা, সে কথা যে রাখবে না তার সাথে আর নো কথা | সোজা সাপ্টা হিসাব |
কিন্তু সেই বন্ধুটি কিছুদিন পর থেকে আর না পেরে চলে আসতো আমাদের কাছে, আমাদের ল্যাজে লাজে ঘুরতো আর আমাদের মানানোর চেষ্টা করতো | “শোন না, আমি তো বলেই ছিলাম তোদের শেখানো কথা গুলো, বললাম তো স্কুল থেকে ফিরে আমার পেট খারাপ হয়ে গেছে, আজ যেতে পারবো না | মাকে বুঝিয়ে দিলেও বাবাকে বোঝাতে পারলাম না তো, বাবা এমন বকা দিলো আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না রে | “ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি, খেয়ে রেডি হয়ে নে, তারপর আমার সাথে চল তোকে আজ টিউশনে আমি ছেড়ে দিয়ে আসবো | আর হ্যাঁ, তোদের আজ কি যেন একটা ক্লাস টেস্ট ছিল না? পড়া হয়েছে তো ঠিক ঠাক? চল চল, আর দেরি করিস না, রেডি হয়ে নে তাড়াতাড়ি” | এখন তোরাই বল, এভাবে বকাঝকা করলে কিভাবে আমি না গিয়ে পারি?” আমাদের ওই বন্ধুটি মুখ কাঁচুমাচু করে বললো |
আর ব্যাস, পাথর গলে গেলো ওই এক মুহূর্তেই |
“হ্যাঁরে, পড়া তো কিছুই করিস নি, তাহলে টেস্টে কি লিখলি? কিছু কি আদৌ লিখেছিলি?”
-“না তো, স্যার কে সব সত্যি কথাই বলে দিলাম, যে একই দিনে সকালে ফিজিক্স পরীক্ষা আর বিকেলে বায়োলজি পরীক্ষা পড়ে গেছিলো তাই ফিজিক্স পড়েছি বায়োলজি আর পড়া হয়নি |”
-“তা, স্যার কি বললেন?”
-“স্যার প্রথমে রেগে গেলেন, বললেন যে আমার কাছে পড়া না করে চলে এলি আর ফিজিক্স স্যারের কাছে পড়ে গেলি? তোদের কাছে ফিজিক্স টা বেশি ইম্পরট্যান্ট, বায়োলজি নয়?”
আমি কিছু বলিনি আর, তারপর স্যার হেসে দিলেন, আর বকলেন না | শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “তা তোর গ্যাং এর আর কেউ এলোনা যে আজ? ও, তার মানে এটা একটা সাজানো গোছানো প্ল্যান ছিল তোদের, আর সেই প্ল্যানটা তুই এসে ভেস্তে দিলি! দেখ এবার তোর বন্ধুরা তোকে বয়কট না করে দেয়, হা হা হা!”
এবাবা, স্যার সব বুঝে গেলেন? তাহলে কি হবে এবার?
আর কি, এর পরের দিন ডাবল টেস্ট দিতে হবে স্যার বলেছেন |
ডবল টেস্ট মানে?
মানে সেদিন তো শুধু তিনটে চ্যাপ্টার এর উপর ক্লাস্ট টেস্ট ছিল, এর পরের দিন স্যার বলেছেন যতটা সিলেবাস পুরো হয়েছে এখনো অব্দি, সব কটা চ্যাপ্টারই পড়ে যেতে হবে |
সব মানে, সব? গোল গোল চোখ করে আমি জিজ্ঞেস করলাম | তারপর আমরা গুনে দেখলাম, সব মিলিয়ে মোট আটটা চ্যাপ্টার শেষ হয়েছে ততদিনে |
কি করবো না করবো বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি, হঠাৎ এক বন্ধু বলে উঠলো, “হায় রে, আমরা তিনটে চ্যাপ্টারের জন্য আগের দিন ডুব দিলাম, এবার একসাথে আটটা করে যেতে হবে?”
-“নাও, ঠেলা সামলাও এবার”, আরেকজন সুযোগ পেয়েই ফুট কেটে দিলো |
-“এর চেয়ে তো ওই তিনটে চ্যাপ্টার দিয়ে কোনভাবে ক্লাস টেস্টটা দিয়ে দিলেই ভালো হতো | ধুর, কে জানতো স্যার এরকম হিটলার হয়ে যাবেন হঠাৎ?”
আরেকজন কথা থেকে বলে উঠলো, “সব হয়েছে এই বোকা বোকা প্ল্যানটার জন্য | আচ্ছা, কে বলেছিলো রে সবাই মিলে ক্লাস টেস্ট বয়কট করতে? সব ঝামেলার মূলে সেইই | কে বলেছিলো, কে বলেছিলো রে?”
প্ল্যানটা আমারই তৎকালীন বেস্ট ফ্রেন্ড এর মস্তিষ্ক প্রসূত ছিল, কিন্তু সে বেচারা এমনই ভয় পেয়ে গেলো শুনে, সবাইকে শান্ত করার জন্যে আমি বললাম, “আমার ছিল প্ল্যানটা | আমার জন্যেই যখন তোরা সবাই ফেঁসেছিস, এখন আমিই দায়িত্ব নিচ্ছি, তোদেরকে কোনোভাবে উৎরে দেওয়ার মতো করে আমি পড়িয়ে দেব, এবারের মতো শান্ত হ সবাই |”
এই একটা কথায় সব ঝামেলা মিটেও গেলো, বন্ধুর সাথে আড়ি পর্ব শেষে ভাবও হয়ে গেলো, তার আবার আমাদের বন্ধুদের গ্যাং-এ সগৌরবে প্রত্যাবর্তন হলো, কিন্তু সেদিন বাকি পিরিয়ডগুলো আমার আর ক্লাসে মন বসলো না, শুধু ভাবতে থাকলাম, বড় গলায় তো বলে ফেললাম পড়িয়ে দেব, কিন্তু আমার নিজেরই তো পড়া হয়নি এখনো |
এবার কি হবে?
এই যে ‘এবার কি হবে’ এই একটা ভাবনা, সেদিনের যুগে এই ভাবনাটা ছিল মস্ত একটা ভাবনা | কারণ আমরা তখন কথা দিলে আপ্রাণ চেষ্টা করতাম সেই কথা রাখার | আর বন্ধুত্বের একটা অলিখিত নিয়ম আর নীরব প্রতিজ্ঞা তো থাকেই, বকা খেলে সবাই একসাথে খাবো, প্রশংসা শুনলেও সবাই একসাথেই প্রশংসা কুড়োবো |
এই যে দিনগুলো ছিল বাঁধনহারা আনন্দের, হাসি কান্নায় ঘেরা একটা মায়াবী জগতের, সেটাকে কি আজ রূপকথা বলা যায়না?
বন্ধুত্বের আঁচলে পরম মমত্বে বাঁধা ছিল একটা ডোর, সেই ডোর আজ অনেক বছরই হয়ে গেলো আলগা হয়ে গেছে, কিন্তু ওই দিনগুলো তো রয়েই গেছে স্মৃতির ক্যানভাসে, এক একটা রূপকথা হয়ে, হয়তো বা জীবনের রূপকথার এক একটা পৃষ্ঠা হয়ে | সময়ের অযত্নে, মান অভিমানের পালা সামলাতে সামলাতে, সেই পৃষ্টাগুলো আজ বড়ই মলিন, কিন্তু এরকম কিছু কিছু টুকরো স্মৃতিরা সেই মলিন হয়ে যাওয়া রূপকথার পাতা থেকে মাঝে মধ্যেই উঁকি ঝুঁকি মেরে জানান দেয়, এখনও তারা রয়ে গেছে সেখানেই |
অবিকল সেই দিনগুলোর মতোই, সিধাসাধা, বাঁধনছাড়া, বেপরোয়া – এক একটা সত্যি রূপকথা |

Leave a comment